২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বন্দি খালেদা জিযা আরো শক্তিশালী

বেগম জিয়া - ছবি : সংগৃহীত

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা আগামী দিনের জন্য কত বড় ইতিহাস হতে পারে তা যদি বুঝতে হয়, তবে আপনাকে মধ্যযুগের স্বাধীন বাংলার ইতিহাস পড়তে হবে। আমাদের বর্তমান জমানার স্বাধীনতার বয়স হতে চলল প্রায় ৪৮ বছর- যা আমাদের অনেকের কাছে সুদীর্ঘ মনে হলেও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই সময় অতি অল্প। কারণ, অতীতে অনেক রাজা-বাদশাহ ছিলেন, যারা একাধারে ৫০-৬০ বছর গৌরবের সাথে রাজত্ব করে গেছেন। অথচ আমরা খুব অল্প লোকই তাদের সম্পর্কে জানি। অন্য দিকে, বাংলাদেশের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে এই ভূখণ্ড বহুবার স্বাধীন হয়েছে এবং বহুবার স্বাধীনতা হারিয়েছে অথবা বিসর্জন দিয়েছে। একইভাবে এ অঞ্চলের মানচিত্রও শত শতবার নয়, অন্তত হাজারবার পরিবর্তিত হয়েছে। আজকের বাংলাদেশের যে মানচিত্র তা প্রথমবারের মতো সৃজিত হয়েছিল বাংলার স্বাধীন সুলতান সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আমলে। সুলতানি আমলের সেই স্বাধীনতা ও মানচিত্র প্রায় ২০০ বছর টিকে ছিল।

সুলতান সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আগে সুলতান ফখরউদ্দিন মুবারক শাহ এবং সুলতান তুগ্রিল স্বাধীনতার জন্য বহু চেষ্টাতদ্বির লড়াই-সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করেছেন, কিন্তু দিল্লির সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে পেরে ওঠেননি। দিল্লির শাসকদের আধিপত্যবাদ এবং বাংলার সহায়-সম্পত্তির ওপর সীমাহীন লোভের কারণে সেই মধ্যযুগ থেকে যে অপতৎপরতা শুরু হয়েছিল, তা বর্তমান জমানায় এসে কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তা এ দেশের রাজনীতিসচেতন মানুষমাত্রই খুব ভালো করে জানেন এবং বোঝেন। দিল্লি কেন বাংলার বিরুদ্ধে তৎপর হয় এবং বাংলার মুসলমানেরা কেন ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, এর কারণ ব্যাখ্যা করে বিখ্যাত সুফি সাধক হজরত নুর কুতুবুল আলম রহ: বাংলার স্বাধীন সুলতান এবং ইলিয়াস শাহী বংশের উজ্জ্বল নক্ষত্র গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের কাছে একখানা পত্র লিখেছিলেন। সেই পত্রে তিনি সুলতানকে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মুসলমানদের শত্রু-মিত্র সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছিলেন। সুলতান সম্ভবত হজরত নুর কুতুবুল আলমের উপদেশ বাস্তবায়ন করতে পারেননি। ফলে গণেশ নামে তার একজন ভৃত্যের হাতে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন হয়েছিল।


বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলের বহু কাহিনী রাজনীতির ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। সম্পূর্ণ বিরূপ পরিস্থিতিতে প্রবল ক্ষমতাধর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে কিরূপে বাংলার জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছিল অথবা সময়ের প্রয়োজনে পিছু হটে অথবা পালিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল- তা মধ্যযুগীয় ভারতীয়, আরবীয় ও চৈনিক ইতিহাসবাদীদের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি। সেসব ইতিহাসের সাথে যদি কেউ ২০১৮ সালের বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ তুলনা করেন, তবে তিনি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবেন, শান্ত-শীতল পরিবেশের মধ্যে এমনতর চাপা উত্তেজনাকর এবং উত্তপ্ত ঘটনা ইতঃপূর্বে ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রধানতম দু’টি রাজনৈতিক জোটের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা-অবিশ্বাস, সন্দেহ, অশ্রদ্ধা এবং একে অপরকে নিঃশেষ করে দেয়ার প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে কারো বেঁচে থাকার আকুতি অথবা কারো বিজয়ী হওয়ার স্বপ্নবাসরকে ধূলিসাৎ করে দেয়ার জন্য যে নির্বাচন নামক রাজনৈতিক যুদ্ধ হতে যাচ্ছে, তা দেশের প্রায় ১১ কোটি ভোটারকে কমবেশি যোদ্ধা হিসেবে মাঠে নামিয়ে নিয়ে এসেছে।
অতীতে কোনো যুদ্ধের ময়দানে ১১ কোটি সৈনিক ছিল না। অন্য দিকে, আধুনিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে ১১ কোটি ভোটার প্রায় সমসংখ্যক হারে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার ভোটকে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যার উপলক্ষ বিবেচনা করে নিজেদের জন্য স্মরণকালের বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও ঝুঁকি নিয়ে নির্বাচনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তা কোনো দেশে ইতঃপূর্বে ঘটেনি। 

এবারের ভোটের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো- একপক্ষ কেবল ভোটযুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে এগোচ্ছে। কারণ, ভোট ছাড়া তাদের হাতে বিকল্প কিছুই নেই। অন্য দিকে, প্রতিপক্ষের হাতে বিকল্প তিন-চারটি পন্থা থাকার কারণে তাদের শ্রম, বুদ্ধি এবং লক্ষ্য পৌঁছার দৃঢ়তাও তিন চার ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এটা যেমন এক দিকে তাদের জন্য সহায়ক হতে পারে, তেমনি সমান তালে বিপদ ও বিপত্তি ডেকে আনতে পারে। উভয়পক্ষই নিজেদের পক্ষ ভারী করার জন্য যে রাজনৈতিক মিত্রতা গড়ে তুলছে, তা বাংলার ইতিহাসে ইতঃপূর্বে দেখা যায়নি। বিশেষ করে বিএনপির সাথে যারা নির্বাচনী ঐক্য করেছেন তারা কেউ কোনো দিন বিএনপির সাথে ঐক্য করতে পারেন তা স্বপ্নেও ভাবা হয়নি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে যারা বিএনপির সাথে ঐক্য করেছেন তাদের সাথে বিএনপির রাজনীতির কতগুলো মৌলিক পার্থক্য ছিল। দেশের প্রচলিত রাজনীতি এবং জনগণের সেন্টিমেন্ট উপেক্ষা করে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের জাসদ, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর দল, মাহমুদুর রহমান মান্না ও সুলতান মুহাম্মদ মনসুরের দলসহ সুশীলসমাজের কিছু জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব যথাÑ ড. শাহদীন মালিক, ড. আসিফ নজরুল, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখরা যদি চেষ্টাও করতেন তবে তাদের পক্ষে বিএনপির সাথে একমঞ্চে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। অধিকন্তু সাবেক বিএনপি নেতা এবং বর্তমানের এলডিপি সভাপতি ড. অলি আহমদ বীর বিক্রমসহ বিগত এক-এগারোর কারণে বিএনপি থেকে ছিটকে পড়া প্রায় এক ডজন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং ভোটের মাঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে বিএনপির গত ১০ বছর ধরে সম্পর্কের যে টানাপড়েন চলছিল, যা উভয়পক্ষ শত চেষ্টা করেও নিষ্পত্তি করতে পারেনি, তা হঠাৎ করে এই নভেম্বর মাসে এসে অলৌকিকভাবে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

বিএনপির অত্যন্তরেও হাজারো সমস্যা ছিল। বিএনপিতে তারেক রহমানপন্থী ও খালেদা জিয়াপন্থীদের মধ্যে স্পষ্টত স্নায়ুযুদ্ধ প্রকট হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রধান রাজনৈতিক মিত্র এবং বিগত বিএনপি জোট সরকারের অংশীদার জামায়াতে ইসলামীর সাথে মতবিরোধ, ভুল বোঝাবুঝি এবং দূরত্ব নিয়ে বহু কথা, কল্পকাহিনী ও গুজবে সারা দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছিল। নভেম্বর মাসে এসে জামায়াত-বিএনপির বিরোধের পরিবর্তে বিস্ময়কর মিত্রতার নজির স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। গত ১০ বছরে বিএনপির অভ্যন্তরে আরো কিছু সমস্যা ছিল। কিছু নেতা একে অপরকে সরকারের দালাল বলে গালি দিতেন। কারো কারো বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাথে যোগসাজশ করে দল ভাঙার অভিযোগ ছিল। বিএনপির কিছু জনপ্রিয় নেতা সরকারের ‘বি’ টিম হিসেবে গত পাঁচ বছর ধরে সংগঠিত হচ্ছিলেন। বিএনপি ভাঙলে তারা যাতে নেতৃত্ব বসতে পারেন অথবা বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসার ঘোষণা দেয়, সে ক্ষেত্রে তারা যাতে বিএনপির নামে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সরকারি আনুকূল্যে নির্বাচন করতে পারেন সে জন্য বিগত পাঁচ বছর প্রায় ৩০০ সংসদীয় আসনে প্রার্থী ঠিক করে গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সরকারসমর্থক কিছু মিডিয়া এবং প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই সব নেতা বিগত দিনগুলোতে যে ফন্দি এঁটেছিলেন, তা নভেম্বর মাসে এসে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অধিকন্তু ওই সব নেতাও বিএনপির মনোনয়ন কিনেছেন এবং সম্ভবত তারা মনোনয়নও পাবেন।

বিএনপির ভেতরে এবং বাইরে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার রাজনীতির যে মেরুকরণ হয়েছে তা এক দিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি সুদূরপ্রসারী ভিন্নমাত্রার রাজনীতি শুরু হওয়ার ইঙ্গিত বহন করছে। এই মেরুকরণের বিপরীতে সরকারি দল ও জোটের মধ্যে বিস্ময়কর কিছু ঘটেনি। তাদের পুরনো মিত্রদের সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যা নিয়ে দলের ভেতর ও বাইরে রয়েছে পরস্পরবিরোধী নানামুখী জল্পনা-কল্পনা ও প্রতিক্রিয়া। কেউ বলছেন- হেফাজতের কারণে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়বে। অন্য দিকে, বিরূপ মন্তব্যকারীরা দশমুখে প্রচার করছেন, আওয়ামী লীগ তার যে শ্রেণিচরিত্র অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতির মূলে কুড়ালের আঘাত করেছে, যা প্রকারান্তে তাদের ভোট কমাবে। জাকের পার্টি, যুক্তফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস প্রভৃতি দল ও জোটের সাথে আওয়ামী লীগের মিত্রতায় ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলবে না। অধিকন্তু আওয়ামী লীগে অন্তঃর্দ্বন্দ্ব প্রবল ও প্রকট হবে। কারণ, দলের অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীকে বাদ দিয়ে নতুন মিত্রদের মনোনয়ন দেয়া হলে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই ফল বিপর্যয় ঘটবে। আওয়ামী জোটে নতুন করে বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে। কারণ, বিএনপি জোটের নতুন মেরুকরণের কারণে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ খুব ভালো করেই নিজের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। কাজেই তাদের দাবি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হওয়া আওয়ামী লীগকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সাথে জাতীয় পার্টির বন্ধন ও বন্ধুত্ব বহু দিনের। তারা বিভিন্ন সময়ে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করেছে। রাজনৈতিক মিত্রতার পাশাপাশি তারা একত্রে সরকারও পরিচালনা করেছে; কিন্তু এর পরও তাদের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য ও সম্মানজনক কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আওয়ামী লীগ মনে করে, এরশাদকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না, কারণ তিনি সকাল-বিকেল সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সব সময় টাকার জন্য খাই খাই করেন এবং সরকারকে একটু বিব্রতকর অবস্থায় দেখলেই উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করেন। পরে আবার কাক্সিক্ষত দ্রব্য পাওয়ার পর চুপ হয়ে যান। কাজেই তিনি যদি বিএনপি থেকে ভালো প্রস্তাব পান এবং সময় ও সুযোগ নিজের অনুকূলে দেখতে পান তবে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ইউটার্ন করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করতে তার দুই-তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না। অন্য দিকে, জাতীয় পার্টির অভিযোগও কম নয়। তাদের মতে, আওয়ামী লীগ তাদের কোনো দিন বন্ধু মনে করেনি। তারা তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে এবং অন্য সময়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। জাতীয় পার্টিকে অসম্মান করে এবং লোকসম্মুখে খোঁটা দিয়ে তাদের হেয় প্রতিপন্ন করা আওয়ামী লীগের অভ্যাস হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে মারাত্মক দুর্বল এবং অকার্যকর একটি রাজনৈতিক শক্তি বানানোর যে প্রচেষ্টা গত পাঁচ বছর ধরে করে চলেছে, তাতে ন্যূনতম সম্মানবোধ থাকলে যেকোনো লোকের মনেই ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে।

সরকারি মদদে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরে বেগম রওশন এরশাদ এবং এরশাদের মধ্যে যে সঙ্ঘাত-মতবিরোধ ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, তা অনেক কষ্টে একটি সমঝোতার জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে এরশাদের ব্যক্তিগত বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। দলের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক অবস্থাকেও তারা বর্তমান সময়ে বিগত পাঁচ বছরের তুলনায় ভালো বলে মনে করছেন। অধিকন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কারো গৃহপালিত ‘বি’ টিমের অপবাদ থেকে মুক্ত হয়ে একটু স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য এরশাদের হাপিত্যেশ সরকারি মহলকে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। এরই মধ্যে গুজব রটে গেছে যে, যুক্তফ্রন্টের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল এরশাদের সাথে তার বারিধারার প্রেসিডেন্ট প্যালেসে দেখা করতে যাবেন। অন্য দিকে, খবর বের হয়েছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার সাথে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনপূর্ব হাসপাতাল ভর্তির তুলনা করে কেউ কেউ দুর্নাম ছড়াচ্ছেন। এমনতর পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কিছু বলা না হলেও জাতীয় পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, এরশাদ নিয়মিত মেডিক্যাল চেকআপের অংশ হিসেবে সিএমএইচে ভর্তি হয়েছেন। সরকার জোর করে তাকে আগের মতো সিএমএইচে নেয়নি।

উল্লিখিত বিষয়াদি নিয়ে যখন আজকের নিবন্ধটি লিখছি তখন হঠাৎ খবর পেলাম, গত শনিবার রাতে সিএমএইচ থেকে ছাড়া পেয়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তার বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় ফেরেননি। তিনি অজ্ঞাত স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন। এমনতর পরিস্থিতিতে তাকে নিয়ে রাজনৈতিক গুঞ্জন আরো প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। অন্য দিকে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে থাকা তারেক রহমান হঠাৎ করেই লাইম লাইটে চলে এসেছেন আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহের কারণে। উচ্চতর আদালতের একটি বিচারিক সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্র অথবা টেলিভিশন বিগত দিনে তারেকসংক্রান্ত কোনো খবর প্রচার করছিল না; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে স্কাইপের মাধ্যমে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণ ভঙ্গের অভিযোগ এনে তা নিষ্পত্তির জন্য আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনে আপত্তি তোলে, যা দেশের সব মিডিয়ার সংবাদ শিরোনামে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন সচিব প্রেসকে জানান, তারেক রহমান নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেননি।

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যত দিন মুক্ত ছিলেন, তত দিন শত চেষ্টাতদ্বির করেও দলের অভ্যন্তরের বহুমুখী সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তিনি মামলা-মোকদ্দমা, সরকারি তাপ-চাপ এবং দলীয় কোন্দলে ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। রাজনৈতিক মিত্রের খোঁজে তিনি অনেক চেষ্টা করেছেন। নিজে ডা: বদরুদ্দোজার বাসায় গিয়েছেন। ড. কামাল, কাদের সিদ্দিকী, মান্না প্রমুখের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাননি। অধিকন্তু তার পুরনো মিত্রদের কেউ কেউ দল ভেঙে সরকারের সাথে যোগ দিয়েছেন। তার দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সহচর ও কূটনীতিবিদ শমসের মবিন চৌধুরী হঠাৎ করেই বিএনপি ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কর্নেল অলির নেতৃত্বাধীন এলডিপি এবং জামায়াতের সাথেও দূরত্ব বাড়ছিল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল, গয়েশ্বর রায়, মির্জা আব্বাস ও রুহুল কবির রিজভীর কাজকর্মে সমন্বয় হচ্ছিল না। আবদুল আওয়াল মিন্টু ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে নিয়েও তিনি দলের অভ্যন্তরে কিছু প্রভাবশালী নেতাদের বিরোধিতার মুখোমুখি হচ্ছিলেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মনে করেছিল, বিএনপি নামক দলটি হয় নিঃশেষ হয়ে যাবে, নতুবা তাদের জাতীয় পার্টি, জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টি অথবা তরিকত ফেডারেশনের মতো ভাগ্য বরণ করতে হবে।

সরকার তাদের ঈপ্সিত সফলতার ষোলোকলা পূর্ণ করার স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখতে আরম্ভ করল সে দিন, যে দিন বেগম জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। বেগম জিয়ার বন্দিত্ব নিয়ে সরকার যেসব আশঙ্কায় শঙ্কিত ছিল তার একটিও ঘটেনি। ফলে সরকার যখন প্রচণ্ড আত্মতৃপ্তিতে ঢেঁকুর দিতে দিতে বেগম জিয়ার বন্দিত্ব এবং মুক্তি নিয়ে নানান কৌতূহলোদ্দীপক তুচ্ছতাচ্ছিলের ব্যঙ্গ শুরু করল, তখন বিএনপির চুপ করে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকল না। এ অবস্থায়, প্রায় একটি বছর কেটে যাওয়ার পর সরকার যখন একাদশ সংসদ নির্বাচন করার উদ্যোগ নিলো, তখন সবাই ধরে নিলো আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন একটি উপলক্ষ মাত্র। কারণ সব কিছু তাদের ইচ্ছেমতো, তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক এবং পূর্বনির্ধারিত ছক মতোই হবে। সরকারি দলের অনেকে আবেগে বলেই ফেললেন, বিজয় নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে এসে নাটকীয়ভাবে বাংলার রাজনীতির নাট্যমঞ্চে এমন সব দৃশ্য আমরা দেখছি, যা ছিল কল্পনারও অতীত। বিএনপির জন্য রাজনীতির মঞ্চে এমন সব বিষয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে একের পর এক মঞ্চায়িত হচ্ছে, যা খালেদা জিয়া জেলের বাইরে থাকলে কোনো দিন সম্ভব হতো না। ফলে বন্দী খালেদা জিয়া মুক্ত খালেদা জিয়ার চেয়ে শক্তিশালী নাকি দুর্বল অথবা তাকে বন্দী করা ভুল হয়েছে নাকি সঠিক হয়েছে ইত্যাদি আলোচনায় বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চায়ের টেবিল, ড্রয়িংরুম এবং সামাজিক আড্ডা সরগরম হয়ে উঠেছে। 
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement